খুলনার লবণচরা এলাকার দরবেশ মোল্লা গলির ট্রিপল খুনের রহস্য ঘণীভূত হচ্ছে। সন্দেহের তালিকায় নিহত মোস্তাকিম (৮) ও ফাতিহার (৬) পরিবারের সদস্যরাও বাদ যাচ্ছে না। এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পুলিশ কয়েকটি একাধিক বিষয় সামনে রেখে কার্যক্রম চালাচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে শিশু দু’টির বাবা শেফার আহমেদ বাদী হয়ে থানায় অজ্ঞাত পরিচয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ওই পরিবারের একজনকে হেফাজতে নিয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ।
এজাহারে শেফার আহমেদ উল্লেখ করেন, রবিবার সকাল ৯ ট ২০ মিনিটের দিকে দুইটি সন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। ওই দিন দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে মেয়ে ফাতিহাকে দাঁতের চিকিৎসা করানোর জন্য বাড়ি থেকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে যান এবং সাড়ে ১২টার দিকে চিকিৎসা শেষে ফাতিহাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তিনি আবারও অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যান।
মামলায় তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, একই দিন রাত ৮টার দিকে তার স্ত্রী রুবি আক্তার কর্মস্থল থেকে ফিরে বাড়ির মেইন গেটে মাকে ডাকাডাকি করলে ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। এ সময়ে শিশু দু’টির গৃহ শিক্ষক আরাফত হোসেনও রুবি আক্তারের সাথে ছিলেন। পরবর্তীতে তার রুবি আক্তার ফাঁকা স্থানে থেকে হাত ঢুকিয়ে গেট খুলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন। বিষয়টি শেফার আহম্মেদ জানতে পেরে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি ঘরের দরজা এবং বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন দেখতে পান। এমন অবস্থায় শেফার আহমেদ দু’টি সন্তানকে খুঁজতে থাকেন। পরবর্তীতে ঘরের মধ্যে মুরগির খামারে শ্বাশুড়ি মহিতুন্নেছা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পাশে দুইটি সন্তান মোস্তাকিম এবং ফাতিহা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয়দের সহায়তায় তাদের দু’জনকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ইজিবাইকযোগে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসক তাদের দু’জনকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দিলে সেখানে মুহিতুন্নেছার মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট করে।
এদিকে শেফার আহম্মেদ ট্রিপল মার্ডারের সন্দেহের তীর তার মামাতো ভাই শামীম আহম্মেদের দিকে ছুড়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে লবণচরা থানায় বসে শেফার আহম্মেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, রূপসা আইচগাতী ইউনিয়ন ভবানীপুর গ্রামের একটি জায়গা নিয়ে তাদের বিরোধ রয়েছে। এ ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শামীম আহমেদ একটি জাল দলিল তৈরি করে সেটা ভোগ দখলের চেষ্টা করেছিল।
তিনি আরও জানান, বছরখানেক আগে অস্ত্রসহ শামীম রূপসা পুলিশের কাছে একবার গ্রেপ্তারও হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। তাছাড়া ঘটনাস্থল একটি মাদক কারবারের কেন্দ্র বিন্দু সেখান থেকে প্রতিদিন মাদক বিকিকিনি হয়। মাদক ব্যবসায়ীরা এমন কা- ঘটাতে পারেও বলে তিনি সন্দেহ করছেন।
একটি সূত্র জানায়, ট্রিপল-এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য আরও ঘণীভূত হচ্ছে। মোস্তাকিম এবং ফাতিহার মা রুবি আক্তার একেক সময় একেক রকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিচ্ছেন। তার কথাবার্তা অনেকটাই সন্দেহজনক বলে পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়। শুধু তিনিই নন-সন্দেহের তালিকায় এই পরিবারের অনেকেই রয়েছেন বলে জানা গেছে।
সূত্রটি আরও জানায়, হত্যাকারীরা প্রথমে শিশু মোস্তাকিম এবং ফাতিহাকে হত্যা করে। তাদেরকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার নানি মহিতুন্নেছা বাথরুমে গোসল করছিলেন। তিনি গোসল করে বের হওয়ার পর তাকে হত্যা করা হয়। দুপুরের পরে যে-কোনো সময় এই তিনটি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।
সূত্রটি আরও জানায়, ওই পরিবারের সর্বসর্বা ছিলেন রুবি আক্তার। ভূমি অফিসে চাকুরি করার সুবাদে তার নামে অনেক অর্থসম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদের দেখভাল করতেন তিনি। তার সিদ্ধান্তের বাইরে স্বামী শেফার আহমেদ কোনো কথা বলার সাহস করতেন না। দুই সন্তানের মৃত্যুতে শেফার আহমেদ অসুস্থ হয়ে পড়লেও রুবি আক্তার গত তিনদিনে একবারও কাঁদেননি। বরং পুলিশের একাধিক সংস্থা তার সাথে হত্যার বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বার বার তার শিক্ষাগত (এমএ পাশ) যোগ্যতা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। এমনকি আশপাশের মানুষকে এড়িয়ে চলছেন। পুলিশ কথা বলতে চাইলে রুমের মধ্যে ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। মানুষের সামনে কোনো কথা বলতে চাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিহত মহিতুন্নেছার এক দেবরকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সে অনেক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসলেও তাকে থানা অভ্যন্তরে কোনো কিছু না বলার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও আমরা যে-সব তথ্য পাচ্ছি তার আলোকে পরিবারকেও আমরা সন্দেহের বাইরে রাখছি না।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রতিপক্ষের সাথে জমি-জমা নিয়ে বিরোধ, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে নিজেদের মধ্য থেকে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে কিনা এসব অনেক বিষয় সামনে রেখে পুলিশ কাজ করছে। এছাড়া সিআইডি, পিবিআই, ডিবি এবং র্যাব-৬ ও ছায়া তদন্ত করছে।
লবণচরা থানার অফিসার ইনচার্জ হাওলাদার সানওয়ার হুসাইন মাসুম বলেন, মামলা হয়েছে। ঘটনা শুনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। ঘটনাস্থলে গিয়ে মহিতুন্নেছার লাশ পাই এবং মোস্তাকিম ও ফাতিহাকে নিয়ে বাবা শেফার আহম্মেদ চিকিৎসার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়। সুরতহাল ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ তাদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরে তারা মামলার জন্য লবণচরা থানায় আসেন। ঘটনার পরপর আমার সকল আলামত সংগ্রহ করেছি। রক্তমাখা ইট ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সেখানে ফিঙ্গারিং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। অচিরে আমরা প্রকৃত দোষীদের আইনে মুখোমুখি করতে সমর্থ হব। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। শিশু দু’টির মাথায় বিভিন্নস্থানে ইট দিয়ে আঘাত করে মারা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জায়গা-জমি নিয়ে শেফার আহম্মেদের সাথে আত্মীয়দের সাথে গ-গোল আছে। ট্রিপল মার্ডারটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। আমরা সবদিক দিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছি। তবে প্রাথমিকভাবে পারিবারিক বিরোধকে প্রাধান্য দিয়েছি। প্রকৃত দোষীদের গ্রেপ্তার করা হবে। এ মামলায় কাউকে অযথা হয়রানি করব না।
খুলনা গেজেট/এনএম

